বরগুনা প্রতিনিধিঃ
বরগুনা পৌর শহর থেকে বুড়ির চর ইউনিয়নের গুলবুনিয়া পর্যন্ত খনন করা নয় কিলোমিটার দৈর্ঘের ‘ভাড়ানী খাল’ এখন শহর ও উভয় পাড়ের বাসিন্দাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বরগুনা জেলা সদরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটি খননের পর স্রোতে উভয় পাড়ে তীব্র ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বরগুনা-পৌর শহরের একাংশ সহ বরগুনা- বাঁশবুনিয়া- গুলবুনিয়া সড়কটিও হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়াও নয় কিলোমিটারে খালে নির্মাণ করা মোট ১১টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে শহরের দুটি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর বরগুনা প্রেসক্লাবে বরগুনা পৌরশহরের খাকদোন ও ভাড়ানী খালের দুই পাড় সংরক্ষণ, উপকূলীয় সুরক্ষায় বেরিবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে খাকদোন নদী ও ভাড়ানীখালের দুপাড় উঁচু করে বাঁধ ও গাইডওয়াল নির্মাণসহ বনায়ন, শহরের জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে কালভার্ট ও স্লুইসগেটগুলো সংস্কার, খাকদন নদী, ভাড়ানীখাল খনন, শহরের পর্যটন শিল্পকে দৃষ্টিনন্দন করার বিষয় আলোচনা করা হয়। এতে পাউবোর বরিশাল বিভাগীয় তত্ত¡াববধায়ক প্রকৌশলী মো. কাইছার আলম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বরগুনা পৌরসভার মেয়র কামরুল আহসান মহারাজসহ সচেনত নাগরিকরা ভাড়ানী খালের ভাঙন নিয়ে আলোচনা ও প্রতিকারে গাইড ওয়ালসহ সুরক্ষা বøক স্থাপনের দাবি জানান।
এসময় আলোচনায় বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানির হোসেন কামাল বলেন, জোয়ার ভাটার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে তরিঘরি করে অপরিকল্পিতভাবে খালটি খনন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সুবিধার জন্য খনন করা হলেও এখন সেই খননই উভয় পাড়ের বাসিন্দাদের বসতিসহ স্থাপনা, উভয় পাড়ের সড়ক ও ১১টি সেতুর জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। দ্রæত উভয় পাড়ে সুরক্ষা বøক স্থাপন না করলে সড়ক, সেতু ও পাড়ের বসতিসহ অনেক স্থাপনা খালের পেটে চলে যাবে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দখল ও দূষণে মৃতপ্রায় ভাড়ানি খালটি পুনরুদ্ধারে পরিবেশবাদী বেশ কয়েকটি সংগঠন আন্দোলন ও পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা উচ্চাদালতে দখলমুক্তে আইনী লড়াইয়ের পর খাল দখলমুক্ত ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে উচ্ছেদাভিযান শুরু করে। পাউবো কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালটি খননের কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স গরীবে নেওয়াজ ও পটুয়াখালীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল মামুন এন্টারপ্রাইজ যৌথভাবে কার্যাদেশ পায়। বরাদ্দকৃত এই কাজের দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ স্থানভেদে ২৬ থেকে ৩০ মিটার বা ৮৫ থেকে ১০০ ফুট এবং নিম্নস্তরের প্রস্থ ১২ মিটার বা ৩৯ দশমিক ৩৬ ফুট এবং গভীরতা ১ দশমিক ৫ মিটার থেকে ২ মিটার পর্যন্ত বা ৫ ফুট থেকে ৬ দশমিক ৫০ ফুট। ২০২২ সালের ফেব্রয়ারী মাসে খালটি খননেনর কাজ শেষ হয়। খননের ফলে খালটিতে এখন অবাধে জোয়ার-ভাটার প্রবাহ শুরু হওয়া মাত্র তিন মাসের মধ্যেই উভয় পাড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। আষাঢ় শ্রাবনের বৃষ্টি ও জোয়ারের তোড়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে বরগুনা শহরের মাদ্রাসা ও জেলা পরিষদ এই দুটি সেতু ঝুকিপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে সেতুতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। খাল খননের ফলে পিলারের নিচের মাটির ভিত নড়বরে হয়ে যায়। স্রোতে তোড়ে মাটি ভেসে গিয়ে একইভাবে শহরের মাছ বাজার থেকে শুরু করে গুলবুনিয়া পর্যন্ত মোট ১১টি সেতু ঝুঁিকপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এছাড়া খালের পশ্চিম পাড়ের বরগুনা-চালিতালী সড়কের পৌর শহরের মাদ্রাসা সড়ক থেকে শুরু করে খাদ্যগুদাম হয়ে জেলা স্কুল ও বাঁশবুনিয়া এলাকার বেশ কয়েকটি স্থানে সড়কের একাশং ভেঙে খালে পড়েছে। একইভাবে পূর্বপাশের শহীদস্মৃতি সড়ক হয়ে মাইঠা, লবনগোলা থেকে গুলবুনিয়া পর্যন্ত ভাঙনে ভাঙনে ঝুঁিক মুখে রয়েছে খালের পাড়ের বেশ কিছু স্থাপনা।
বরগুনা পৌরশহর সংলগ্ন বাঁশবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা জুনাইদ জুয়েল বলেন, অনেক আন্দোলনের পর খালটি দখলমুক্ত করার পর অপরিকল্পিতভাবে খননের পর এখন ভাঙনের শিকার হচ্ছে সড়ক, স্থাপনা পারাপারের জন্য সেতু। খালটি খননের সময় মাছ বাজার থেকে বাঁশবুনিয়া পর্যন্ত সুরক্ষা ব্লক স্থাপন করা হলে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি উভয় পাড় সুরক্ষিত থাকত। তবে পাউবো চাইলে এ প্রকল্প এখনো হাতে নিতে পারে।
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহবায়ক মোঃ হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করেছি, খাল দখলমুক্ত হয়েছে এবং খননের কাজও শেষ। কিন্ত এখণ যে অবস্থা খাল কেটে কুমির আনা হয়েছে। উপকার হয়েছে, কিন্ত যে ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা থেকে সুরক্ষা দিতে পাউবোর ভূমিকা রাখতে হবে। দ্রæত খালের উভয় পাড়ে সুরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করে বøক স্থাপন না করলে হুমকীর মুখে পড়বে, সড়ক ব্রিজ ও এলাকার বাসিন্দাদের বসতি। খালটির উভয় পাড়ে এখন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করলে এটি মানুষের ঘোরাফেরা ও বিনোদনের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে।
বরগুনার পৌর মেয়র কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ইতোমধ্যে পৌর শহরের দুটি ব্রিজ ঝুঁকিতে থাকায় বন্ধ করা হয়েছে। আমি বিষয়টি পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিভাগীয় প্রকৌশলীর সাথে আলাপ করেছি। ওনারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা পাউবোকে সব ধরণের সহায়তা দিতে প্রস্তত।
পাউবো বরিশাল বিভাগীয় তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কাইছার আলম বলেন, পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ করা যায় না। বরগুনায় ৫টি প্রকল্প অনুমোদন চাওয়া হলেও ২টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। খাকদন নদী ও ভাড়ানীখালের পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করে অনুমোদন প্রস্তাব করা যেতে পারে।
News Desk/WE